ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যার প্রতিবাদে ও হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশ। বৃহস্পতিবার তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় প্রতিটি বড় শহরে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ শুরু হয়। গতকালও রাজধানীর শাহবাগে দিনভর আগ্রাসনবিরোধী সমাবেশ করেছে ছাত্র-জনতা। এ ছাড়া জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, রাজধানীর উত্তরাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষোভ-সমাবেশ করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।
জাতীয় নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরদিন গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে রাজধানীর বিজয়নগর কালভার্ট রোড এলাকায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হন ওসমান হাদি। গত সোমবার এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার রাতে হাদির মৃত্যুর খবর আসার পর দ্রুতগতিতে রাজধানীর শাহবাগ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সমবেত হতে থাকেন বিক্ষুব্ধ লোকজন। বিক্ষোভকারীরা হাদির রক্ত বৃথা যেতে দেব না এবং বিচার চাই, বিচার চাই স্লোগান দেন।
এরপর গতকাল সকাল ৭টার দিকে বিভিন্ন পেশার মানুষকে ফের শাহবাগে অবস্থান নিতে দেখা যায়। সকালে উপস্থিতি তুলনামূলক কম থাকলেও সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জমায়েত বড় হতে থাকে। জুমার নামাজের পর হাদির হত্যাকারীদের দ্রুত বিচারের দাবিতে শাহবাগ উত্তাল হয়ে ওঠে। সমাবেশে ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েম ঘোষণা দেন, এখন থেকে শাহবাগের নাম হবে শহীদ ওসমান হাদি চত্বর । ওসমান হাদির খুনিদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত ঘরে না ফেরার ঘোষণা দিয়ে তিনি ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। গণঅধিকার পরিষদের সেক্রেটারি রাশেদ খান বলেন, হাদির হত্যাকারীদের বিচারের আগ পর্যন্ত আমরা আন্দোলন বন্ধ করব না। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে বলতে চাই, হত্যাকারীদের বিচার না হলে আপনি চেয়ারে থাকতে পারবেন না। আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ বলেন, হাদি ভাইকে যারা শহীদ করে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল, তাদের স্পষ্ট করে বলতে চাই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাব। হাদি ভাইয়েরা শাহাদাতের মাধ্যমে সারা দেশ প্রমাণ করেছে, ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের স্থান এ দেশে হবে না।
এদিকে, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় গতকাল ঢাকায় জুমার নামাজের পর শাহবাগের অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দুপুরে ফেসবুকে দেওয়া এক বিবৃতিতে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, জুমার নামাজের পর যে কোনো কর্মসূচিতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করুন। গতকালের মতো ভাঙচুর ও নাশকতা করার পরিকল্পনা রয়েছে জুলাইবিরোধী শক্তিগুলোর। জনগণের ক্ষোভকে ব্যবহার করে কোনো হঠকারী গ্রুপ কোথাও ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ অথবা কোনো নাশকাতমূলক কার্যক্রম যাতে করতে না পারে, সে ব্যাপারে ভূমিকা পালন করুন।
হাদির হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গতকাল বিকেলে ছাত্রদলের উদ্যোগে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়। কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল, ঢাবি ছাত্রদল ও মহানগর ছাত্রদলের বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীরা অংশ নেন। কর্মসূচি শেষে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে চার দাবিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়। দাবিগুলো হলো শহীদ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডে জড়িত হত্যাকারী, পরিকল্পনাকারী, মদদদাতাসহ সবাইকে দ্রুত শনাক্ত করে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের আওতায় আনতে হবে; হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র ও সংশ্লিষ্টদের অবহেলা খতিয়ে দেখতে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে; ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড রোধে গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহি ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ক ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, স্থগিত পরীক্ষার সূচি শিগগির ঘোষণা করা হবে। এ ছাড়া গতকাল সন্ধ্যায় ঢাবির কেন্দ্রীয় মসজিদে ইনকিলাব মঞ্চের উদ্যোগে হাদির রুহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
বায়তুল মোকাররমে বিক্ষোভ: ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বিভিন্ন সংগঠন। শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত বিচার, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করে বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস। একই সময় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখাও হাদি হত্যার প্রতিবাদে বায়তুল মোকাররম এলাকায় বিক্ষোভ করে। এ ছাড়া বিক্ষোভ করছে সম্মিলিত জুলাই জোট নামে আরেকটি সংগঠন।
উত্তরায় বিক্ষোভ-সমাবেশ: শুক্রবার বাদ জুমা বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ঢাকা মহানগর উত্তরের উদ্যোগে রাজধানীর উত্তরায় প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল হয়। দলটির ঢাকা মহানগর উত্তরের সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতি নেয়ামতুল্লাহ আমিনের সভাপতিত্বে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরাসহ জুমার নামাজ শেষে উত্তরা এলাকার বিভিন্ন মসজিদের মুসল্লি, আলেম-ওলামা ও সচেতন জনতা এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। সমাবেশে বক্তারা বলেন, হাদি হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদী দমন-পীড়নেরই ভয়াবহ বহিঃপ্রকাশ। অবিলম্বে হত্যাকারীদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না করলে জনমনে চরম ক্ষোভ তৈরি হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তারা।
রাজশাহীতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের অফিস: ওসমান হাদির মৃত্যুর খবরে বৃহস্পতিবার রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল নিয়ে শহরের জিরো পয়েন্টে গিয়ে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা বুলডোজার দিয়ে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয় গুঁড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া সমাবেশ থেকে দেশের দুটি দৈনিক পত্রিকা বন্ধের ঘোষণা এবং রাজশাহী থেকে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশন উচ্ছেদের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
ঝিনাইদহে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে আগুন: হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বৃহস্পতিবার রাতে বিক্ষুব্ধ লোকজন একপর্যায়ে জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কনক কান্তি দাস এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এ ছাড়া শহরের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের একাধিক নেতার বাড়িতে হামলার খবর পাওয়া গেছে।
বান্দরবানে সাবেক মন্ত্রীর বাসভবনে আগুন: হাদির মৃত্যুর খবরে বিক্ষুব্ধ লোকজন বৃহস্পতিবার রাতে বান্দরবান শহরে রাজার মাঠ এলাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈ সিংয়ের বাসভবনে আগুন দেয়। বান্দরবান ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউসের পরিদর্শক ইফতেখার মাহমুদ বলেন, ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে গেলেও কয়েক দফা বাধার মুখে পড়ে। পরে সেনাবাহিনী এসে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। জেলা পুলিশ সুপার আবদুর রহমান জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পুলিশের একজন সদস্য আহত হয়েছেন, বর্তমানে পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে।
হাতিয়ায় থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ: গতকাল সন্ধ্যায় হাতিয়া থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে বিক্ষুব্ধ লোকজন। বিক্ষোভকারীরা থানা ফটকের সামনে অবস্থান নিয়ে ওসমান হাদি হত্যার সঙ্গে জড়িত খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে পুলিশ অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
গোপালগঞ্জে জয় বাংলা চত্বরের নাম পরিবর্তন করে শহীদ হাদি চত্বর : গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে জয় বাংলা চত্বরের নাম পরিবর্তন করে শহীদ হাদি চত্বর নাম রেখেছে শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঙ্গবন্ধু কর্নার ও জুলাই আন্দোলনবিরোধী পাঁচ শিক্ষককে আপসারণে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে।
কফিন মিছিল: ওসমান বিন হাদিকে হত্যার প্রতিবাদে গতকাল লক্ষ্মীপুর ও নওগাঁ শহরে কফিন মিছিল করেছে ছাত্র-জনতাসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
গায়েবানা জানাজা: ওসমান হাদিকে হত্যার প্রতিবাদে গতকাল ছাত্র-জনতার উদ্যোগে মাগুরার সরকারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ চত্বরে, ফেনীর মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে, খুলনার শিববাড়ি মোড়ে, নীলফামারী শহরের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে, রংপুর নগরীতে, খুলনা শহরের খুলনা রোড মোড়ে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন: ওসমান হাদিকে হত্যার প্রতিবাদে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বাগেরহাট, বরিশাল, ময়মনসিংহ, ভোলা, কুমিল্লা, ফরিদপুর, কক্সবাজার, ফেনী, হবিগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, যশোর, গাজীপুর, খুলনা, নাটোর, মেহেরপুর, পটুয়াখালী, নড়াইল, নীলফামারী, রাজবাড়ী, রংপুর, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছে ছাত্র-জনতা ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী ও শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন।
